হাসিনা : এক দুর্ভেদ্য দেয়াল
প্রকাশিত : ১৫:৫৩, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ | আপডেট: ১৭:৩৭, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১
শেখ হাসিনা ওয়াজেদ, এক দুর্ভেদ্য দেয়ালের নাম; বাংলা মায়ের এক নির্ভীক সন্তানের নাম। তিনি বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বিশ্ববরেণ্য নেত্রী। তিনি বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদের সরকার দলীয় প্রধান এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী।
এত এত পরিচয়ের ভীড়ে আমি আজ সে মানুষটির কথা বলব যিনি তার বাবার দেশপ্রেমের চেতনাকে ধারণ করেছেন নিজের মাঝে, যিনি বাবার অনুপস্থিতিতে সামলেছেন পুরো পরিবারকে, পুরো পরিবারকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়েও যিনি ভোলেননি এ দেশের কথা, এ দেশের মানুষের কথা; নিজের বিপদ হবে জেনেও যিনি ফিরে এসেছিলেন তার প্রিয় মাতৃভূমিতে, স্বামী সন্তানের সাথে সুখ-শান্তির জীবনের পরিবর্তে যিনি বেছে নিয়েছিলেন দেশসেবাকে। হ্যাঁ, আমি আজ সেই মানুষটির কথা বলব যিনি দেশের জন্যে বিলিয়ে দিয়েছেন তার পুরো জীবনকে।
২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭, রবিবারের দিনে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ ফজিলাতুন্নেছা দম্পতির ঘর আলো করে জন্ম নেন শেখ হাসিনা। যার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান, এমন একজন মানুষ যিনি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য আজীবন লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন, তার মেয়ে যে বাবার মতোই দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ লালন করবেন সে তো জানার কথাই। নিজের পরিবারের সকলকে হারানো যে ঠিক কতোটা কষ্টের তা আমি আপনি না উপলব্ধি করতে পারব, না কল্পনা। ১৯৭৫ সালের সেই কালো রাতে পুরো পরিবারকে হারানোর পর তিনি চাইলে দেশের বাইরেই কাটাতে পারতেন তার জীবন। কিন্তু তার মাতৃভূমি যে ভালো নেই! তার দেশের মানুষ যে সুখে নেই!! তার বাবার স্বপ্নের সোনার বাংলা যে নির্মাণ হয় নি!! বাবা যে তাকে কখনো পিছু হটতে শেখাননি!! বিপদে পিছু হটা যে তার ধাঁচে নেই! দেশের, দেশের মানুষের দুর্দিনে তিনি দূরদেশে শান্তিতে থাকতেন কি করে?? আর তাই ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে প্রত্যাবর্তন করেন। নিরাপদ জীবনের পরিবর্তে তিনি বেছে নেন দেশকে, দেশের মানুষকে। এখানেই বুঝা যায় তিনি তার মাতৃভূমিকে ঠিক কতোটা ভালোবাসেন..
আওয়ামী লীগ ১৯৮১ সালে সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনাকে তার অনুপস্থিতিতে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে অবশেষে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন।
এদেশে তার জন্যে যে কতটা বিপদ অপেক্ষা করছিল তার উদাহরণ পাওয়া যায় ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলার ঘটনায়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় এক জনসভায় বক্তৃতাদানকালে গ্রেনেড হামলায় এই নেত্রী অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। উক্ত হামলায় তার ঘনিষ্ঠজন এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন মৃত্যুবরণ করেন ও শতাধিক আহত হন। বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে এই হামলাকে বিদেশি ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করা হয়। এই গ্রেনেড হামলার তদন্তকে ভিন্ন খাতে করার জন্য 'জজ মিয়া' নাটক সহ বেশকিছু প্রহসন সৃষ্টি করেছিল তৎকালীন চারদলীয় ঐক্যজোট প্রশাসন। পরবর্তীতে দেশি ও বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সুষ্ঠু তদন্তে বেরিয়ে আসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা নাসিরুদ্দিন আহমেদ পিন্টু, যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মুজাহিদ, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (বর্তমানে বাংলাদেশে বিলুপ্ত) নেতা মুফতি হান্নানসহ বেশকিছু তৎকালীন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম।
তার শত্রুরাও আসলে আন্দাজ করতে পেরেছিল এই এক মহিলা ঠিক কতটুকু শক্তিশালী! এই একজন বেঁচে থাকলে তারা এই দেশটার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর তাইতো উনার উপর হামলা হয়েছে বারবার। কিন্তু বাংলা মা কি করে হারিয়ে যেতে দিতেন তার সবচেয়ে প্রিয় মেয়েকে? আর তাইতো তিনি আগলে রেখেছিলেন তার মেয়েকে, আর তাইতো ভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা বেঁচে ফিরে এসেছেন বারবার বিজয়ীর বেশে..
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেকেরই ধারণা নারীরা জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা, নারীরা শাসন করতে পারেনা। তাদের চিন্তাধারা পাল্টে দিয়ে তিনি সুচারুভাবে সামলেছেন পুরো দেশকে এবং এ দেশকে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী রূপে সেবা দিয়ে গেছেন তিনি।
এই মহিলা শত্রুরা যখন দেশের ক্ষতি করতে যায় তখন তাদের সামনে পর্বত সমান বাঁধা, শত্রুদের মুখের উপর কড়া জবাব দেওয়া শক্তমনের এক নারী; আবার এই মহিলাই করুণার আধার, যিনি দেশের মানুষের কষ্টে দুঃখ পান, রাত জেগে মোনাজাত করেন দেশের ভালোর জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণ কামনায়..
রাজনীতির পাশাপাশি তিনি একজন লেখক ও। তারই হাত ধরে আমরা পেয়েছি অত্যন্ত চমৎকার কিছু বই। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০টি গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন।
এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, ‘সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র’, ‘ওরা টোকাই কেন’, ‘বিপন্ন গণতন্ত্র’, ‘সাদা কালো’, ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (গ্রন্থে রূপান্তর), ‘People and Democracy’, ‘The Quest for Vision 2021’, ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’।
‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণমূলক আত্মজীবনীমূলক রচনা। এখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবন এবং তার পরিবারের নানা অজানা তথ্য তুলে ধরেছেন। এখান থেকে আমরা জানতে পাই শেখ হাসিনার লড়াই সংগ্রামের কথাও।
শেখ হাসিনার ‘ওরা টোকাই কেন’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। বইটির প্রথম অধ্যায়ের নাম স্মৃতির দখিন দুয়ার। গ্রামে জন্মেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু অনেক শহরবাসীর মতো গ্রামের সেই স্মৃতি ভুলে যাননি। তাইতো তিনি লিখতে পারেন, "আমার শৈশবের স্বপ্ন-রঙিন দিনগুলো কেটেছে গ্রাম বাংলার নরম পলিমাটিতে, বর্ষার কাদা পানিতে, শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে, জোনাক-জ্বলা অন্ধকারে ঝিঁঝির ডাক শুনে, তাল-তমালের ঝোপে বৈঁচি, দীঘির শাপলা আর শিউলি- বকুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে, ধুলোমাটি মেখে, বর্ষায় ভিজে খেলা করে।"
আর সে জন্যেই তিনি জানিয়েছেন আজও গ্রামের প্রকৃতি শৈশব তাকে পিছু টানে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর গ্রামীণ জীবনের মানোন্নয়ন ও শ্রমের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি যেভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে আমাদেরও সেভাবে এগিয়ে যেতে হবে বলে শেখ হাসিনা মনে করেন। সে কারণে তিনি গ্রামোন্নয়নের জন্যে কী করা দরকার সে ধারণার কথা সেই আশির দশকের শেষ দিকেই তার ‘ওরা টোকাই কেন’ বইতে লিখেছেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের অনেক সময়ই কেটেছে জেলখানায় বন্দি অবস্থায়। ১৯৬৬-৬৯ সালে তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি ছিলেন। এ নিরিবিলি নিরানন্দ সময়গুলোতে বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এবং সহধর্মিণীর অনুপ্রেরণায় তিনি জীবনী লেখা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি পাক হানাদার বাহিনীর দখলে ছিল। এই বাড়িতেই একটি ড্রেসিংরুমের আলমারির উপরে অন্যান্য খাতাপত্রের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা এই আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, ডায়েরি, ভ্রমণ কাহিনীও ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী সমগ্র বাড়িটি লুটপাট ও ভাঙচুর করলেও এই কাগজপত্রগুলোকে মূল্যহীন ভেবে অক্ষত রেখে যায়।
পঁচাত্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাড়িটি জিয়া সরকার কর্তৃক সিলগালা করে দেওয়া হয়। ১৯৮১ সালে বাড়িটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এ সময় ঐ বাড়িতে শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিকথা, ডায়েরি ও চীন ভ্রমণের খাতাগুলো খুঁজে পাওয়া গেলেও তার আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপিটি পাওয়া যায়নি; শুধু কয়েকটি ছেঁড়া-উইপোকায় কাটা টাইপ করা ফুলস্কেপ কাগজ পাওয়া যায়।
দীর্ঘদিন পর ২০০৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের এক ভাগ্নে অতি পুরানো-জীর্ণপ্রায় এবং প্রায়ই অস্পষ্ট লেখার চারটি খাতা শেখ হাসিনাকে এনে দেন। তিনি এই খাতা চারটি শেখ মুজিবের আরেক ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে সংগ্রহ করেন। এই লেখাগুলোকে বঙ্গবন্ধু হারিয়ে যাওয়া পূর্বোক্ত আত্মজীবনী হিসেবে সুনিশ্চিত করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে শেখ মণিকে টাইপ করার জন্য এগুলো দেওয়া হয়েছিল। পরে এগুলো বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সম্পাদনায় গ্রন্থাকারে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামে ২০১২ সালের জুনে প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে এটি ‘The Unfinished Memoirs’ নামে ইংরেজিতেও প্রকাশ করা হয়, যার ভাষান্তর করেন ড. ফকরুল আলম।
শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা জানতে পারি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে।
বিশ্বের ক্ষমতাধর নারী নেত্রীদের মাঝে তিনি অন্যতম।
পদ্মাসেতু- যা ছিল একসময় বাঙ্গালীদের স্বপ্ন, তা বাস্তবে রূপলাভ করেছে তার হাত ধরেই।
আমার কাছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা মায়ের প্রিয় কন্যা, শেখ মুজিবের আদরের প্রিয় কন্যা... যিনি তার বাবার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন দিনরাত। বারবার যিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও মুখ ফিরিয়ে নেননি দেশের দিক থেকে, দেশের মানুষের দিক থেকে..
নারীশিক্ষার হার তার আমলেই বেড়েছে কয়েক গুণ। যার জন্যে নারীরা আজ নির্বিঘ্নে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে, কর্মক্ষেত্রে রাখতে পারে তাদের মেধার নজির, সেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৪তম জন্মদিনে আমার শুভেচ্ছা রইল বাংলা মায়ের এই নির্ভীক সন্তানের প্রতি..
- কলাম লেখক
এসএ/